Recent in Technology

রুশ বাহিনীর ওপর ইউক্রেনের পাল্টা-হামলার ভবিষ্যৎ যে তিন দিকে যেতে পারে

ইউক্রেনীয় সৈন্য আর্টেম বিশ্বাস করেন না যে রুশ বাহিনীকে সম্পূর্ণরুপে পরাজিত করা সম্ভব হবে

অ্যানেসথেশিয়ার প্রভাব কমে আসার সাথে সাথে অ্যাম্বুলেন্সের পেছন দিকে ১৯-বছর বয়সী হাড্ডিসার এক সৈনিকের বিলাপ শোনা গেল। তার শরীরের জায়গায় জায়গা কাদা লেগে আছে। অক্সিজেন মাস্ক হাতড়াতে হাতড়াতে তিনি বিড়বিড় করে বললেন: “আমাকে আমার রাইফেলটা দাও।”
“তাদের অবস্থা প্রায়শই এরকম হয়। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত,” সৈন্যটির বিষণ্ণ মুখে টোকা দিতে দিতে বলেন ড. ইন্না দিমিতির। সৈন্যটি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি জাপোরিশার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রণক্ষেত্র থেকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করলো।

এই তরুণ সৈন্যটির নাম ওলেহ। সেদিন সকালে তিনি ছিলেন একটি পরিখার ভেতরে। এসময় রাশিয়ার ছোড়া একটি মর্টার বিস্ফোরিত হলে তার টুকরো ওলেহর শরীরে আঘাত করে। এর ফলে তার পিঠে একটা বড় গর্ত তৈরি হয়। সম্ভবত তার স্পাইনাল কর্ড ভেঙে গেছে।

“তার অবস্থা স্থিতিশীল, কিন্তু গুরুতর। তার মতো আহত এরকম অনেক সৈন্য আমরা পাই,” বলেন ড. ইন্না দিমিতির। এসময় তার হাতে ছিল এরকম আহত আরো অর্ধ-ডজন সৈন্যের নামের তালিকা।

“তাদের অবস্থা প্রায়শই এরকম হয়। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত,” সৈন্যটির বিষণ্ণ মুখে টোকা দিতে দিতে বলেন ড. ইন্না দিমিতির। সৈন্যটি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি জাপোরিশার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রণক্ষেত্র থেকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করলো।

এই তরুণ সৈন্যটির নাম ওলেহ। সেদিন সকালে তিনি ছিলেন একটি পরিখার ভেতরে। এসময় রাশিয়ার ছোড়া একটি মর্টার বিস্ফোরিত হলে তার টুকরো ওলেহর শরীরে আঘাত করে। এর ফলে তার পিঠে একটা বড় গর্ত তৈরি হয়। সম্ভবত তার স্পাইনাল কর্ড ভেঙে গেছে।

“তার অবস্থা স্থিতিশীল, কিন্তু গুরুতর। তার মতো আহত এরকম অনেক সৈন্য আমরা পাই,” বলেন ড. ইন্না দিমিতির। এসময় তার হাতে ছিল এরকম আহত আরো অর্ধ-ডজন সৈন্যের নামের তালিকা।

পশ্চিমা অর্থে পরিচালিত একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা মোয়াসের হয়ে কাজ করেন তিনি।

রুশ বাহিনীর ওপর ইউক্রেনের পাল্টা হামলায় হতাহত সৈন্যের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে এধরনের অভিযানে রুশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে কতোটা অগ্রগতি ঘটানো সম্ভব সেবিষয়ে কিছু কিছু সৈন্য ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

“আরো (পশ্চিমা) সাহায্য ছাড়া, আমার মনে হয় এই খেলায় আমরা হেরে যাবো,” বলেন ইউক্রেনীয় এক মেরিন সৈন্য কিরিলো পোট্রাস। দু’বছর আগে রুশ মাইনের আঘাতে তার বাম পায়ের নিচের অংশ উড়ে গেছে। এই পা নিয়ে তিনি আবার ফ্রন্ট-লাইনে ফিরে এসেছেন রুশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে।

মি. পোট্রাস বলছেন, রাশিয়ার এই বিশাল মাইনফিল্ড তাদের জন্য অন্যতম বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“রুশদের কাছে অনেক ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী বন্দুক ও মিসাইল আছে,” বলেন তিনি।

দীর্ঘ সময় ধরে ইউক্রেনের পরিকল্পিত এই পাল্টা আক্রমণের এক মাস পার হয়েছে। কেউ কেউ যেমন এনিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন, তেমনি অনেক সৈন্য ও বিশেষজ্ঞ আছেন, যারা ভিন্নমত পোষণ করেন। তার মনে করেন শুরুটা পরিকল্পনা অনুসারেই অগ্রসর হয়েছে। 

তারা মনে করেন যেখানে যুদ্ধ চলছে, যে ফ্রন্ট-লাইন কৃষ্ণ সাগরের উপকূল থেকে ইউক্রেনের উত্তর-পূর্ব রুশ সীমান্ত পর্যন্ত এক হাজার কিলোমিটার ধরে বিস্তৃত, সেটা খুব দ্রুত গতিতে ভেঙে ফেলা সম্ভব নয়।

বিবিসির সাংবাদিক অ্যান্ড্রু হার্ডিং গত কয়েক সপ্তাহ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে তিনটি পৃথক ফ্রন্ট-লাইনে গিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তার মনে হয়েছে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ নিয়ে মোটা দাগে তিন ধরনের আলোচনা রয়েছে।

একটি গ্রুপ মনে করে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যূহ টিন দিয়ে তৈরি, আরেকটি গ্রুপ মনে করে সেটি কাঠের তৈরি এবং তৃতীয় গ্রুপটি মনে করে যে রুশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাঁচের মতো।

'টিন তত্ত্বটি'- যা পরিবর্তন করা সম্ভব কিন্তু ভঙ্গুর নয়- তিনি প্রথম পেয়েছেন দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে ডনবাসের বাখমুত শহরের কাছের একটি ফিল্ড হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে।

গোলাবর্ষণের তীব্র শব্দের মধ্যেই ওই চিকিৎসক বিবিসির সাংবাদিককে বলছিলেন যে ইউক্রেনের হতাহত সৈন্যের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলার জন্য রাশিয়া লম্বা সময় পেয়েছে, তাদের প্রচুর সৈন্য রয়েছে। তার উপসংহার হচ্ছে: ফ্রন্ট-লাইন রাশিয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া ইউক্রেনীয় সৈন্যদের জন্য বেশ কঠিন হবে।

“আমি মনে করি রণক্ষেত্রে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে না। রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে এর অবসান ঘটবে,” বিষণ্ণ মুখে একথা বলেন তিনি।

অন্যদিকে 'কাঠ তত্ত্ব' বলতে এন্ড্রু হার্ডিং বুঝিয়েছেন ইউক্রেন-রাশিয়ার ফ্রন্ট-লাইন হয়তো মট করে ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে, কিন্তু ধসে পড়বে না।

কৃষ্ণ সাগরের উপকূল পর্যন্ত যে বিস্তৃত জমি এবং উঁচু নিচু পাহাড় সেদিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা রুশ বাহিনীকে পিছু হটাতে চেষ্টা করছে। মাইনফিল্ডের ভেতর দিয়ে রাস্তা খুঁজে সেই পথ ধরে অগ্রসর হয়ে তারা রুশ সৈন্যদের অবস্থানের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালাতে চাইছে।

তবে এই আক্রমণ চালানো হবে ধীরে ধীরে এবং নিয়মিতভাবে। তারা চাইছে বিভিন্ন গ্রাম ও ছোট ছোট শহর পুনর্দখল করতে।

“আমি একজন বাস্তববাদী, যদিও কেউ কেউ আমাকে বলে আমি একজন হতাশাবাদী,” বলেন ৩৬ বছর বয়সী এক সৈন্য আর্টেম। তার সঙ্গে কথা বলার সময় মাথার উপর দিয়ে একটি ইউক্রেনীয় বিমান গর্জন করে উড়ে যাচ্ছিল।

তার মত হচ্ছে রুশ সৈন্যদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা আগামী কয়েক মাসে হয়তো উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি ঘটাতে পারবে। তবে তিনি মনে করেন না যে এই পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে রুশ বাহিনীকে সম্পূর্ণ রূপে পরাজিত করা সম্ভব হবে।

“মিডিয়া ও সমাজ খুব তাড়াহুড়ো করছে। কিন্তু খারাপ তো হতেই পারে,” বলেন তিনি। তবে আর্টেম জানেন না রুশ ফ্রন্ট-লাইনে ভাঙন ধরাতে ইউক্রেনকে কতোটা মূল দিতে হবে এবং এজন্য তারা ঠিক কতোখানি প্রস্তুত। 

রুশ মর্টার বিস্ফোরণে আহত ইউক্রেনীয় সৈন্য ওলেহ

এটা চোখে পড়ার মতো- যেসব সৈন্যরা ফ্রন্ট-লাইনের কাছে অবস্থান করছে এবং যারা সরাসরি যুদ্ধের সাথে জড়িত, তাদের কাছ থেকে ইউক্রেনের পাল্টা হামলার ব্যাপারে অন্ধকার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।
হয়তো বলা যাবে যে এই সৈন্যদেরই বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা আছে এবং তাদের মতামত বাস্তববাদী। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও ঠিক যে এই সৈন্যরা কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষিতে যুদ্ধটাকে দেখতে পাচ্ছে না। কারণ তারা ইউক্রেনের বিশাল সামরিক অভিযানের ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র।

পূর্ব ইউক্রেন থেকে বিবিসির সংবাদদাতা অ্যান্ড্রু হার্ডিং বলছেন, তার 'গ্লাস তত্ত্ব'র পেছনে যে ধারণা কাজ করছে তা হচ্ছে: ইউক্রেনের পাল্টা হামলা যথাযথভাবেই চলছে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহে, অথবা মাসে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, তখন ইউক্রেন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে নিতে সক্ষম হবে এবং তারা ক্রাইমিয়া উপদ্বীপের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছাবে।

প্রখ্যাত পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষক মিক রায়ান এবং যুক্তরাজ্যে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান স্যার টনি র‍্যাডাকিনের মতো জেনারেলরাও এই একই ধারণা পোষণ করেন।
এই তত্ত্বের যারা সমর্থক তারা হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়েছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে বিমান-শক্তির অভাবে ইউক্রেন প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার রসদ-সরবরাহ লাইন ও কমান্ড সেন্টারকে, তাদের কাঙ্ক্ষিত দ্রুত গতিতে ভেঙে দিতে পারছে না।
একারণে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে স্থল-ভিত্তিক মিসাইল ছুঁড়ে এই কাজটা করতে হচ্ছে। একই সাথে শত্রুপক্ষের সৈন্য-শক্তি ও সরঞ্জামাদি ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য তারা একই সময়ে যতো বেশি সম্ভব রুশ সামরিক অবস্থানেও আক্রমণ পরিচালনা করছে।

ইউক্রেনের কৌশল হবে “অপেক্ষা করা, ছড়িয়ে পড়া এবং আক্রমণ করা,” বলেন ব্রিটেনের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ স্যার টনি। তিনি বলেন, রাশিয়া ইতোমধ্যে “তার সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ করার কার্যকারিতা অর্ধেক হারিয়ে ফেলেছে।”

আরেকটি ফিল্ড হাসপাতালে যেখানে ১৯-বছর বয়সী আহত ইউক্রেনীয় সৈন্য ওলেহকে সামান্য চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, সেখানে একজন ইউক্রেনীয় চিকিৎসক ইয়েভেন যা বলেছেন তাতে তাকে অত্যন্ত আশাবাদী বলে মনে হয়েছে।

ইয়েভেন বলেছেন, “প্রত্যেকেই একটা বড় ধরনের অগ্রগতির জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা এটা বিশ্বাস করি এবং তার জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা জানি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমাদেরকে শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে।”

ফিল্ড হাসপাতালের বাইরে সূর্যের নিচে বসে তিনি যখন একথা বলছিলেন, তখনই দূরে কোথাও গোলা নিক্ষেপের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।


Ad Code

Responsive Advertisement